জয়নাল আবেদীন :
পাট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে গোপালপুর। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে পিংনায় পুলিশ স্টেশন হলে বৈরান তীর নন্দনপুরে গড়ে উঠে পাট বেলিং কারখানা। প্রসেস করা পাট যমের নৌকায় চালান যেতো কোলকাতায়। নারায়নগঞ্জের আদমজীতে। বৈরান তীর নন্দনপুরে চৌধুরীরা নির্মাণ করেন আলীশান বাড়ি। তখন হিন্দু জমিদার ও সামন্ত শ্রেণীরা জড়িত ছিল পাট ব্যবসায়। নন্দনপুরের চৌধুরীদের বদাণ্যতায় উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে হয় নন্দনপুর গার্লস হাইস্কুল। চৌধুরী পরিবারের টানে দেশের বিভিন্ন স্থানের হিন্দু মহাজন ও ব্যবসায়ীরা দল বেঁধে নিবাস গাড়ে গোপালপুরে। গড়ে উঠে দোকানপাট ও বাসাবাড়ি। এভাবেই গোপালপুর শহরের পত্তন। নব্য হিন্দু ব্যবসায়ী, জমিদার ও আধা সামন্তপ্রভূদের নিরাপত্তা ও ফুঁটানির জন্য প্রয়োজন হয় পেয়াদা-বরকন্দাজ। হেমনগর ও ধনবাড়ি জমিদারের অনুকরণে এখানের নব্য আধা বুর্জোয়ারা পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার থেকে দারিদ্রপীড়িত একদঙ্গল নিরন্ন আদমকে আমদানি করে। নবাগত এ আদমরাই বাগদী। নন্দনপুর চৌধুরী বাড়ির দুশো গজ উত্তরে খাস জমিতে থাকার ব্যবস্থা হয়। সেই থেকে শতাব্দী ধরে ওই খাস জমিতেই ওদের বাস।
এরপর বৈরান নদীর অনেক জল গড়িয়ে যায়। রাজনৈতিক দল কংগ্রেস-মুসলিম লীগ আত্মপ্রকাশ করে। ইংরেজ আমলে ১৯০৫ এ বৃহৎ বাংলা টুকরো করে বঙ্গভঙ্গ হয়। হিন্দু- মুসলমানে দাঙ্গা ঘটে। ব্রিটিশ রাজত্ব ভেঙ্গে পাকিস্তান হয়। একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ। নানা মাত্রার রাজনৈতিক ওলটপালট, সামাজিক বিবর্তন ও অর্থনৈতিক পালাবদলে পড়শি মুসলিম ও বর্ণ হিন্দুরা বস্তুগত উন্নয়নের সিড়ি বেয়ে অনেক উপরে উঠে। শুধু পিছে পড়ে থাকে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির বাগদীরা। শতাব্দী বছরেও ওরা যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। গোপালপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রধান সড়ক ধরে কোনাবাড়ি বাজারে যাওয়ার পথে একশ গজ সামনে এগুলে হাতের ডানে তিন ফিট প্রশস্ত সরু গলি। গলির প্রবেশ মুখেই বাগদী পল্লী। কেউ ঢুকলে অন্যজনকে কাত হয়ে সাইড দিতে হয়। সরু গলির দুইধারের ভাঙ্গাচোরা টিনের ছাপড়া পলিথিন আর বাঁশের মুডিতে ঘেরা। দুটি পৃথক দাগের বিংশ শতাংশ খাসে ২৩ পরিবারের শতাধিক মানুষের দুর্বিসহ জীবন। ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গোপালপুর পৌরসভা। ওদের নিয়ে কখনোই ভাবেনি কোনো নগর পিতা। সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ক নিয়ে যারা নিরন্তর সরব, তারাও তাকিয়ে দেখেনি বাগদীদের যাপিত জীবনের দুর্বিসহ চালচিত্র।
গত সোমবার ১৪ ডিসেম্বর আমার সহকর্মী, ফটোগ্রাফার এবং গোপালপুর বার্তা ২৪ ডট কম এর বার্তা প্রধান কে এম মিঠুকে নিয়ে বাগদী পাড়ায় গিয়ে আলোর নিচে নিকষ কালো নজরে আসে। পাড়ার প্রবীন বাসুদেব জানান, জমিদার ও নীলকররা সুন্দর জীবনের প্রতিশ্রুতিতে পশ্চিম বঙ্গ ও বিহার থেকে পূর্বপুরুষদের নিয়ে আসে। গোপালপুর শহরের নন্দনপুর ছাড়াও ভেঙ্গুলা, হেমনগর ও ঝাওয়াইল বাজারে বাগদীদের দেখা যায়। গায়েগতরে জোরি হওয়ায় লাঠিয়ালগিরি, পেয়াদাগিরি অথবা পালকি ও ঘোড়ারগাড়ি বাহকের নিয়োগ পায়। এভাবেই কাটে তিন পুরুষের কাল। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ হয়। বনেদী হিন্দুরা সীমান্ত পাড়ি দেয়। দুর্গতিতে পড়ে বাগদীরা। গোপালপুর শহরের বাগদীরা বিকল্প কর্মসংস্থান হিসাবে সেলুন, হোটেলরেস্তোরা, লেবারি, বাসট্রাকের হেলপারি বেছে নেয়। কিন্তু ঝাওয়াইল, হেমনগর ও ভেঙ্গুলার বাগদীরা হতে থাকে উচ্ছেদ আর হয়রানির শিকার। ভেঙ্গুলার বাগদীরা একবার, হেমনগরের বাগদীরা তিনবার এবং ঝাওয়াইলের বাগদীরা একবার উচ্ছেদের শিকার হয়। সরকার যায় সরকার আসে। কত খাসজমি কত ভূমিহীনের নামে বন্দোবস্তি হয়। কিন্তু বাগদীদের ভাগ্যে খাস জমির বন্দোবস্তি জুটেনা। বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদারের প্রচেষ্টায় ভেঙ্গুলা বাজারের ২৫ ঘর বাগদী নদীর পূর্বপাড়ে স্থায়ী ভাবে বসবাস করার দলিলপত্র পেয়েছে। সে যাই হোক, দারিদ্রতার নাগপাশ আষ্ট্রেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলায় অশিক্ষা, কুশিক্ষা, সামাজিক বঞ্চনা ও শোষণ বাগদীদেও ললাটের লিখন হয়ে দাড়িয়েছে।
ফিরে আসি গোপালপুর পৌর শহরের বাগদীদের কাসুন্দি নিয়ে। এখানকার বাগদী শিশুদের অনেকেই দারিদ্রতার কারণে স্কুলে যায়না। গেলেও পঞ্চম শ্রেণী পার না হতেই ঝরে পড়ে। বস্তি সদৃশ পাড়ায় অস্বাস্থ্যকর ও পূঁতিগন্ধময় পরিবেশ। ভাঙ্গাচোরা ছাপড়ার পর ছাপড়া। এর নিচে এক পাশে বউ বাচ্চা। অপর পাশে গরুছাগল, খরগোশ বা হাঁসমুরগী। মানুষ আর পশুপাখিতে মিলে বাস। শীতগ্রীস্মে একই দৃশ্য। সারি সারি ছাপড়ার মাঝ বরাবর সর্পিল তিন ফিটের রাস্তায় বর্ষাকালে একহাটু পানি জমে। জলাবদ্ধতায় ঘরদোরে পানি ঢোকে। পানিবন্দী থাকে শিশুরা। বস্তির দুই পাশেই শিক্ষিত ও অবস্থাপন্ন নাগরিকের বাসাবাড়ি। তাদের কাছে বাগদীরা অচ্ছুত। ছোটজাত। ওদের ঘরদোরের পানি আরো অচ্ছুত। তাই দেয়াল তুলে বাগদী পল্লীর পানি নিস্কাশনের পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। নির্গমনের পথ না পেয়ে বর্ষাবৃষ্টির পানি ঠাঁয় দাড়িয়ে থাকে দিনের পর দিন। স্যাঁতস্যাতে, অপরিচ্ছন্ন, নোংরা গন্ধের ঘ্রাণ নিয়ে বেড়ে উঠে বাগদী শিশু। অশিক্ষা আর অপুষ্টিতে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি হয় ওরা। বর্ষাকালে শহরে এক ফোটা পানি না থাকলেও বাগদী পল্লী থাকে জলে জলাময়। তখন তক্তার পাটাতনের বিছানায় মানুষ আর পশুর এক তালে ঘুমানো আর থাকাখাওয়া। গৃহবধূ বীনা বাগদীর আহাজারি, ‘পাড়ায় এক ইঞ্চি খালি জায়গা নেই। শুস্ক মৌসুমে এতগুলো পরিবারের গোছল ও রান্নাবান্নার ময়লা পানি ফেলা মহা সমস্যা। গৃহিনীরা দূষিত পানি বালতিতে ভরে প্রধান সড়কের ড্রেনে ফেলে আসে।’ এ কাজটি চলে নিরন্তর। স্বাস্থ্য সম্মত লেট্রিন না থাকায় রোগব্যাধি লেগেই আছে। পাড়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। কেউ কেউ চোরাই লাইনে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। সন্ধ্যার পর সারা শহর বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল করলেও বাগদী পল্লী থাকে অন্ধকারে। সারা শহরে গ্যাস ও পানি সরবরাহ থাকলেও বাগদী পল্লী বঞ্চিত।
পাড়ার প্রবীণ জোছনা বাগদী জানান,‘কয়েক পুরুষ ধরে বাগদীরা এখানে বাস করলেও বসতভিটার খাস জমি তাদের নামে বন্দোবস্ত দেয়া হচ্ছেনা। পৌরশহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ জায়গার দাম অনেক। তাই অনেকের চোখ পড়েছে এখানে।’ এরশাদ জামানায় ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে জাপা নেতারা নন্দনপুর এলাকার মেথর ও মুচি পট্রি উচ্ছেদ করে ভিটে জবরদখলে নেয়। অসহায়, দলিত ও প্রান্তিক সম্প্রদায়ের পাশে মিডিয়া ছাড়া কেউ দাড়ায়নি। আখেরে ভিটে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় ওরা। দখল করা প্লট জাপা নেতারা বিক্রিভাট্রা করে টাকা কামায়। স্টেডিয়ামের উত্তরপূর্বকোনে শহরের প্রধান সড়কের পাশেই মেথর ও মুচি পট্রি গড়ে উঠে ইংরেজ শাসনামলে। স্টেডিয়ামের দক্ষিন প্রান্ত জুড়ে ছিল গনিকালয়। আর উত্তর প্রান্তে জুট বেলিং কারখানা। এখন সেখানে অনেক সাহেব-সুবাদের বসবাস। দেখে বোঝার উপায় নেই কখনো প্রান্তিক জনগোষ্ঠির দলিতরা কালাতিপাত করতো। এর দুবছর পর ওই স্বৈরাচার জামানায় ঝাওয়াইল বাজারে বাগদী পল্লীতে হামলা চালায় ইউনিয়ন জাপার নেতারা। অগ্নিসংযোগ করে ভস্মীভূত করে ৩/৪টি বাড়িঘর। দৈনিক ইত্তেফাকসহ তিনটি জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশ হয়। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় হাইকমিশন, মানবাধিকার সংস্থা ও মিডিয়ার ভূমিকায় বাগদীরা সে যাত্রায় রক্ষা পায়। ওই দুটি বর্বর ঘটনা বাগদী সম্প্রদায়ের সবাইর জানা। আর ওই জানা তাদেরকে ভীতি ও উচ্ছেদ আতঙ্কে সর্বক্ষণ তাড়া করে ফেরে।
প্রতিবেদক : গোপালপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি, দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদদাতা এবং মধুপুর কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান।